পৃথিবীর আহ্নিক গতি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে কি হবে?
পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘূর্ণনকে পৃথিবীর আহ্নিক গতি বলে।
আমরা জানি পৃথিবী তার নিজ অক্ষ বরাবর ঘন্টায় ১৬৭৫
কিলোমিটার বেগে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকেঘুরছে।
এই পৃথিবীর পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে আমরাও একই
বেগে পৃথিবীর সাথে ঘুরছি।
কি হবে যদি হঠাৎ করে পৃথিবীর এই ঘূর্ণন থেমে যায়?
হঠাৎ করে পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে গেলে এমন
কিছু ঘটনা ঘটবে, যা আমরা কখনও কল্পনাও করতে পারি না।
পৃথিবী কেবল যদি তার আহ্নিক গতি হারিয়ে ফেলে,
তবে এটি পৃথিবীতে বসবাসরত সমস্তকিছুর জন্য হবে এক ভয়ানক বিপর্যয়।
পৃথিবী সূর্যের অক্ষের ঘোরার সাথে সাথে নিজের অক্ষের চারিদিকেও ঘুড়ছে।
পৃথিবীর এইরূপ ঘূর্ণনকে আবর্তন গতি বলে।
পৃথিবীর তার এই অক্ষে একবার ঘুরতে সময় লাগে ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড।
পৃথিবীর আবর্তন বেগ নিরক্ষীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি এবং মেরু অঞ্চলে সবচেয়ে কম অর্থাৎ শূন্য।
এই সময় যদি পৃথিবীর আবর্তন গতি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে,
প্রথমেই মুহুর্তের মধ্যে পৃথিবীর পৃষ্ঠে থাকা সবকিছু ছিটকে গিয়ে কমপক্ষে ঘন্টায়
১৬৭০ কি.মি বেগে পূর্ব দিকে উড়তে শুরু করবে। মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখি, রাস্তাঘাট, বিল্ডিং,
পাহাড় পর্বত এমনকি মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে সবকিছু
সুনামি
হঠাৎ পৃথিবীর গতিবেগ থেমে যাওয়ার ফলে এর আরেকটি ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া
দেখা যাবে আমাদের পৃথিবীর সমুদ্রের সাথে।
কেবল আমরা সহ পৃথিবীর সকল বস্তুই নয় ;
সমুদ্রের পানি পর্যন্ত পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করবে!
এতে করে প্রথমত সকল সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বিশাল আকৃতির ঢেউ সৃষ্টি হবে ;
যেসব ঢেউ ইতিহাসে কেউ কখনও প্রত্যক্ষ করেনি।
যার ফলে সমুদ্র উপকূলীয় শহরগুলো নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যাবে
আবহাওয়ার পরিবর্তন
পৃথিবীর গতিবেগ থেমে যাওয়ার কারনে, এসময় পুরো পৃথিবীর বায়ুমন্ডল
প্রচন্ড গতিবেগের সাথে সম্পূর্ণ পৃথিবী পর্যায়ক্রমে ঘুরতে থাকবে।
পৃথিবীর এই অ্যাটমোসফিয়ার এত জোরে ঘুরবে যে পৃথিবীতে সেসময় প্রচন্ড গতিতে
বাতাস প্রবাহিত হবে। আর বাতাসের সাথে সাথে কিছুক্ষন পরপর আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটবে
ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শুরু হবে ভয়ানক ধুলোর মেঘ জমা।
যা শুরু করবে প্রচন্ড ঝড় এবং বজ্রপাত। সেই বজ্রপাতের ফলে প্রচন্ড বিদ্যুতায়নের সৃষ্টি হবে।
এর সাথে সাথে, হঠাৎ করে পৃথিবী থেমে যাওয়ায় প্রচন্ড ধাক্কার কারনে
বাতাসে যে বিশাল ঢেউ বা শকওয়েভের সৃষ্টি হবে,
তা পারমানবিক বোমা বিস্ফোরনের শকওয়েভের চাইতে বহুগুন ভারী।
পৃথিবীর সমস্ত জল দুটি সমুদ্রে জমা হবে
পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে গেলে এই প্রচন্ড ধাক্কায় সমুদ্রের সব জল উঠে এসে পৃথিবীর
পরো স্থলভাগ ভাসিয়ে নিয়ে সব জল সোজা মেরুতে চলে যাবে।
কারন পৃথিবী সম্পুর্ণ গোলাকার নয় এবং পৃথিবীর কেন্দ্রাতিক বলের ফলে নিরক্ষীয়
অঞ্চলের সমস্ত জল দুই মেরুতে গিয়ে সঞ্চয় হবে,
তার ফলে দুই মেরুতে দুটি সাগরের সৃষ্টি হবে।
আগ্নেয়গিরি,হারিকেন ঝড় এবং ভূমিকম্প সংগঠিত হবে
পৃথিবীর গতি হঠাৎ থেমে গেলে নানারকম ভয়ানক প্রাকৃতিক দূর্যোগের সূত্রপাত ঘটবে।
হঠাৎ পৃথিবী থেমে গেলে গতিবিজ্ঞানের এক বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ পৃথিবীর কেন্দ্রে
ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করবে। আর এতে করে প্রথমত ঘন ঘন তীব্র ভূমিকম্প হতে থাকবে।
ভূমিকম্পের পাশাপাশি সেসব স্থানে আগ্নেয়গিরি দেখা যায় ;
সেখান থেকে ঘন ঘন অনেকক বেশি পরিমানে আগ্নেয়গিরি উত্তাল হতে থাকবে।
আগ্নেয়গিরি ধীরে ধীরে অনেক বড় শহরে প্রবেশ করে শহরের যাবতীয়
পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে শুরু করবে।
তাছাড়াও পৃথিবীর কেন্দ্রাতিক অবস্থার পরিবর্তনের কারনে হারিকেন ঘূর্নিঝড় সৃষ্টি হবে।
দিন রাত্রির ওপর প্রভাব
পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যও স্থির হয়ে যাবে। অর্থ্যাৎ,
যেখানে দিন ছিলো সেখানে চিরকাল দিনই থাকবে।
যেখানে রাত ছিলো, সেখানে চিরকাল রাতই থাকবে।
পৃথিবীর একদিকে গরম আর এক দিকে শীতল হবে
আর যে অংশ রাত, সেখানে তাপের অভাবে পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে বরফ জমে যাবে।
অর্থ্যাৎ, পৃথিবীর অর্ধেক থাকবে উত্তাপের দখলে, আর বাকি অর্ধেক থাকবে শুধুই বরফ।
পৃথিবী পূর্ন গোলাকার আকৃতিতে রূপান্তরিত হবে
বর্তমানে পৃথিবী সবসময় ঘুরছে বলে ঘোরার সুবিধার্থে পৃথিবীর আকৃতি চ্যাপ্টা।
আর পৃথিবীর এই চ্যাপ্টা প্রকৃতির আকৃতিকে বলা হয় জিওয়েড।
যেহেতু পৃথিবীর স্পিনিং মোশনের জন্য ছিল তার এই চ্যাপ্টা আকৃতি;
তবে যখন পৃথিবী আর ঘুরবে না তখন আর পৃথিবীর এরকম চ্যাপ্টা ভাব আর থাকবে না।
সুতরাং পৃথিবী ঘোরা বন্ধ করলে পৃথিবী চ্যাপ্টা থেকে পরিনত হবে পূর্ন গোলাকারে।
পৃথিবী অতিরিক্ত গরম ও ঠাণ্ডা আকার ধারন করবে
পৃথিবীর আহ্নিকগতি থেমে গেলে পৃথিবীতে আর ১২ ঘন্টা পরপর একপাশে সূর্য আসবে না।
এখানে পৃথিবীকে নির্ভর করতে হবে কেবল তার বার্ষিক গতির অপর।
আর সে কারনে পৃথিবীর যে প্রান্তে সূর্য থাকে সে প্রান্তে দেখা যাবে ৬ মাসের জন্য দিন ;
আর যে প্রান্তে বা পাশে সূর্য থাকবে না সেখানে ৬ মাসের জন্য রাত।
আর আহ্নিক গতি না থাকার ফলে কোনো
স্থানে ৬ মাস ধরে টানা সূর্যরশ্মি সে স্থানের আবহাওয়াগত তাপমাত্রাকে অত্যাধিক উত্তপ্ত করে তুলবে।
একইভাবে বিপরীত পার্শ্বে টানা ৬ মাস ধরে সূর্যের আলো না থাকা এবং চিররাতময় অবস্থা
সে স্থানের আবহাওয়াকে করে দেবে আরও কয়েকগুণ ঠান্ডা ;
অনেকটা অ্যান্টার্টিকা মহাদেশের চেয়ে বেশি ঠান্ডা।
পৃথিবী মারাত্মক সৌরজাগতিক রেডিয়েশন এর স্বীকার হবে
আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবী যখন ঘুরতে শুরু করে ;
তখন ঘোরার সাথে সাথে পৃথিবীর চারিপাশে একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড ক্রিয়াশীল হয়।
এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড আমাদেরকে সৌরমন্ডলীয় বায়ু বা সোলার উইন্ড থেকে
রক্ষা এবং সুরক্ষা প্রদান করে।
তাছাড়াও এই ফিল্ড আমাদের ওজোন স্তরকে রক্ষা করে।
তবে আহ্নিক গতি না থাকলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকবে না – যার ফলে
পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড ধ্বংস হয়ে যাবে
পৃথিবী থেমে যাওয়ার কারনে পৃথিবীর কেন্দ্রের উত্তপ্ত ধাতব অংশটি রয়েছে যেটি
পৃথিবীকে একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ডে আবদ্ধ রেখেছে,
এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড থেমে যাবে বা ধ্বংস হয়ে যাবে।
এর ফলে পৃথিবীর অজন স্তর ও ধ্বংস হয়ে যাবে
ফলে ভয়ানক দাবানলের সৃষ্টি হবে
তাহলে পৃথিবীর গতি থেমে যাওয়ার পর প্রায় ১৬০০ কিমি বেগে যে বায়ু প্রবাহিত হবে তার প্রভাবে কেমন
পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে কল্পনা করুন।
বাতাসের সাথে প্রায় ১৬০০ কি.মি বেগে ঘর্ষণের ফলে পৃথিবীর পৃষ্ঠে আগুন লেগে যাবে।
আর এই আগুন এর জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে ‘অক্সিজেন’!
এই ভয়ানক আগুনের ফলে মহাপ্রলয় সৃষ্টি হবে।
সৌরমন্ডলীয় বায়ু আমাদের পৃথিবীতে প্রবেশ করে মারাত্মক রেডিয়েশন এর সৃষ্টি করবে ;
যার ফলে পৃথিবী আমাদের থাকার অযোগ্য হয়ে পড়বে।
এরকম অবস্থা হলে সমগ্র মানবজাতির বেঁচে থাকার চান্স যদিও কম ;
তবুও আমরা যদি বেঁচে থাকি তবে আমাদেরকে তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে বসতি স্থাপন করতে হবে।
ভূপৃষ্ঠে আমরা বসবাস করতে পারব না কেননা খোলা বায়ুমন্ডলে ততদিনে
যে রেডিয়েশন তৈরি হয়েছে, রেডিয়েশন প্রোটেক্টিভ স্যুট ব্যাতিত
সেখানে বেঁচে থাকা সম্ভব হবেনা। আরও অনেক গবেষনা থেকে দেখা গিয়েছে যে,
চাঁদ ধীরে ধীরে পৃথিবীর নিকট এগিয়ে আসছে এবং
একসময় আমাদের পৃথিবীর সাথে চাঁদের সংঘর্ষ ঘটবে।
এসকল বিষয় থেকে আমরা ধারনা করতে পারি মহাবিশ্ব কতটা সুগঠিত এবং এর একটি বৈশিষ্ঠ্যেরও
যদি ব্যাঘাত ঘটে তবে কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি হতে পারে।
যে পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য পৃথিবীর চিরবিদায় এর চাইতে কম নয়।
অবশেষে পৃথিবীর আহ্নিক গতি কি সত্যি সত্যি থেমে যেতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য নাসা র একটি গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করা যেতে পারে।
নাসার মতানুসারে “দিনের দৈর্ঘ প্রতি ১০০ বছরে ২.৩ মিলি সেকেন্ড করে বৃদ্ধি পাচ্ছে,
অর্থাৎ কয়েক
বিলিয়ন বছর পর দিনের দৈর্ঘ রাতের দৈর্ঘের চেয়ে বেশি হবে।
এরূপ অবস্থায় হয়ত আমাদের পৃথিবির ঘূর্ণন থেমে গেলেও যেতে পারে...
প্রতিবেদন টি সম্পর্কে আপনাদের কোন মতামত থাকলে কামেন্ট বক্স এ
আমাদের জানাতে পারেন
ধন্যবাদ।
Comments
Post a Comment